হুমায়ূন আহমেদ তার এক বইতে বলেছিলেন—‘মৃতদেহ নিয়ে যে গাড়ি যায়, সেই গাড়ির দিকে সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে তাকায়। গাড়িতে একটা লাল নিশান উড়ে। লাল নিশান মানেই শব বহনকারী গাড়ি। তবে সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকালেও মৃতদেহের মুখ কেউ দেখতে চায় না। মৃতদেহ নিয়ে যারা যাচ্ছে, তাদেরকে দেখতে চায়। মৃত মানুষ দেখে কী হবে? মৃত মানুষের কোনো গল্প থাকে না। মানুষ গল্প চায়।’
সত্যিই, আমরা গল্প খুব পছন্দ করি। তাই জীবনের অনেকটা সময় অনর্থক গল্পগজবের পেছনে কাটিয়ে দিই। যেসব গল্পে আমার জন্যে শিক্ষণীয় কিছুই নেই, সেগুলোও বাদ দিই না। যেসব গল্প সুড়সুড়ি দেয়, সেগুলোও এড়িয়ে যাই না। অথচ এমন অনেক গল্পই আছে, যা আমার হিদায়াতের কারণ হতে পারে, আমাকে আমার রবের নিকটবর্তী করে দিতে পারে। কিন্তু ভুলেও সেগুলোর দিকে নজর দিই না।
আজ তোমায় একটি গল্প বলি। তবে গল্পটা নিজের কল্পনা থেকে বানানো নয়, সত্যি গল্প। গল্পটা[1] রাসূলুল্লাহ ﷺ বর্ণনা করেছেন। গল্পটা সে সময়ের, যখন বিচারের মাঠ কায়েম হবে। একে একে বিচার হবে সব বান্দাদের। আর বিচারক হবেন আহকামুল হাকিমীন—আল্লাহ। স্থাপন করা হবে মিজান। মানুষের নেক ও বদ আমলকে ওজন করা হবে মিজানের পাল্লায়। যার নেকির পাল্লা ভারী হবে, সে হবে সফল। আর যার নেকির পাল্লা হালকা হবে, সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত। এভাবে সব বান্দাদের বিচার শেষ হবে। জান্নাতীরা জান্নাতে চলে যাবে, আর জাহান্নামীরা জাহান্নামে। এরপর আর কাউকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হবে না, জাহান্নাম থেকে মুক্তিও দেওয়া হবে না।
একজন লোক জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যিখানে থেকে যাবে। তার চেহারা থাকবে জাহান্নামের দিকে, আর পিঠ থাকবে জান্নাতের দিকে। জাহান্নামের উত্তপ্ত আগুন তার চেহারাকে ঝলসে দিবে। যন্ত্রণায় সে চিৎকার দিয়ে উঠবে। তার ঝলসানো চেহারা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু আগুনের উত্তাপে তা আবার ঝলসে যাবে। এভাবে চলতে থাকবে। আগুনের উত্তাপ না সইতে পেরে লোকটি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বসবে। সে বলবে, ‘হে আমার রব! জাহান্নাম হতে আমার চেহারা ফিরিয়ে দিন। এর দূষিত হাওয়া আমাকে বিষিয়ে তুলছে। এর লেলিহান শিখা আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে।’
এভাবে সে বলতেই থাকবে, বলতেই থাকবে। আল্লাহ তাআলা তার ডাকে সাড়া দেবেন। তিনি লোকটিকে বলবেন, ‘তোমার নিবেদন গ্রহণ করা হলে এ ছাড়া আর কিছু চাইবে না তো?’
আল্লাহ তাআলার কথা শুনে লোকটি খুশি হয়ে যাবে। সাথে সাথে বলে উঠবে, ‘না, আপনার ইজজতের শপথ! আমি আর কিছুই চাইব না।’
এই ওয়াদা দেওয়ার পর তার চেহারা জান্নাতের দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে। লোকটি যখন জান্নাতের দিকে তাকাবে, তখন জান্নাতের অপার সৌন্দর্য তার সামনে ভেসে উঠবে। জান্নাতের নয়নাভিরাম দৃশ্য তাকে আকৃষ্ট করবে। তার মনটা জান্নাতের দিকে ঝুঁকে যাবে। সে চাইবে মহামহিম আল্লাহকে কিছু বলতে, কিন্তু তার ওয়াদা তাকে বলতে বাধা দেবে।
এমন কিছু চাহিদা আছে, যা চাইলেও দমন করে রাখা যায় না। জান্নাতের চাহিদা কি সে ধরনের চাহিদার চাইতেও বেশি নয়?
আমাদের উদ্দেশ্যই তো জান্নাত। সে জন্যেই আমরা দুনিয়ায় এসেছি। সে জন্যেই এত কষ্ট করে যাচ্ছি। অন্যের টিটকারি, উপহাস চোখ বুজে সয়ে নিচ্ছি। তাইতো লোকটি আর চুপ করে থাকতে পারবে না। তার অন্তরে তোলপাড় শুরু হয়ে যাবে। সে বলে উঠবে, ‘হে আমার রব! আপনি আমাকে জান্নাতের দরজার কাছে পৌঁছে দিন।’
আল্লাহ তাআলা তাকে পূর্ব প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে বলবেন, ‘তুমি পূর্বে যা চেয়েছিলে তা ছাড়া আর কিছু চাইবে না—এই বলে তুমি কি অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতি দাওনি?’
আল্লাহ তাআলা–এর কথা শুনে লোকটি চুপ হয়ে যাবে। কিন্তু জান্নাত তাকে আকৃষ্ট করতে থাকবে। তার হৃদয় দুমড়ে-মুচড়ে যেতে থাকবে। লজ্জা ভুলে গিয়ে সে বলবে, ‘হে আমার রব! আমাকে আপনার সবচেয়ে হতভাগা সৃষ্টি বানাবেন না।’
আল্লাহ তাআলা তাৎক্ষণিক জবাব দেবেন, ‘তোমার এ ইচ্ছে পূর্ণ করা হলে এ ছাড়া আর কিছু চাইবে না তো?’
সে বলবে, ‘না, আপনার ইজজতের শপথ! এছাড়া আমি আর কিছুই চাইবো না।’
এভাবে সে বলতেই থাকবে। আল্লাহ তাআলা-কে ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি দেবে। এরপর দয়াময় আল্লাহ তাকে জান্নাতের দরজার কাছে পৌঁছে দেবেন।
কিন্তু জান্নাতকে বাইরে থেকে দেখেই যে ব্যক্তি সইতে পারেনি, জান্নাতের অভ্যন্তরীণ নিয়ামত দেখে সে কীভাবে চুপ করে থাকবে? জান্নাতের অনাবিল সৌন্দর্য ও নির্মল পরিবেশ দেখে ঝড় বয়ে যাবে লোকটির অন্তরে। জান্নাতে প্রবেশের ইচ্ছে তার মধ্যে প্রবল হবে। কিন্তু সে পূর্বের ওয়াদার কথা মনে করে চুপ থাকবে। সে বারবার জান্নাতের দিকে তাকাবে আর ভাববে—হায়, আমিও যদি জান্নাতীদের একজন হতে পারতাম! আমিও যদি জান্নাতের নিয়ামত ভোগ করতে পারতাম! আমিও যদি অনন্ত সুখের ভাগীদার হতে পারতাম! তার অন্তরে তোলপাড় শুরু হয়ে যাবে। একটা সময় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না। চিৎকার দিয়ে বলে উঠবে, ‘হে আমার রব! আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিন।’
লোকটির কথা শুনে মহামহিম আল্লাহ বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! কী আশ্চর্য! তুমি কতটা ওয়াদা ভঙ্গকারী! তোমাকে যা দেওয়া হয়েছে তা ছাড়া আর কিছু চাইবে না—এই বলে কি আমার সাথে অঙ্গীকার করোনি? আর প্রতিশ্রুতি দাওনি?’
সে বলবে, ‘হে আমার রব! আমাকে আপনার সবচেয়ে হতভাগা সৃষ্টি বানাবেন না।’
এভাবে সে আল্লাহ তাআলার কাছে ফরিয়াদ করতে থাকবে। তার কথা শুনে আল্লাহ তাআলা হেসে উঠবেন। সুবহান্নাল্লাহ! যে রব হাসেন, তাঁর থেকে বান্দা কল্যাণ ছাড়া আর কী আশা করতে পারে। আল্লাহ তাআলা তার প্রতি দয়া করবেন। তাকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেবেন। লোকটি জান্নাতে প্রবেশ করবে। এরপর আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘চাও।’
লোকটি একের-পর-এক তার চাওয়াগুলো পেশ করতে থাকবে। সে যা যা চাইবে, তার সবই তাকে দেওয়া হবে। এভাবে চাইতে চাইতে একসময় তার আকাঙ্ক্ষা ফুরিয়ে যাবে। আর চাওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাবে না। তখন কী হবে জানো? স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাকে বিভিন্ন জিনিসের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন। আর বলবেন, ‘এটা চাও, ওটা চাও।’
আল্লাহু আকবার! তুমি এমন রবকে কীভাবে ভুলে যাও, যিনি তাঁর ইলম থেকে বান্দাদেরকে সাহায্য করেন? বান্দা চাইতে চাইতে ঠিকই ক্লান্ত হয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহ দিতে দিতে ক্লান্ত হন না। এমন দয়াময় রবকে কীভাবে ফাঁকি দাও? তোমার কি একটুও লজ্জা লাগে না?
এভাবে আল্লাহ তাআলা লোকটিকে স্মরণ করাতে থাকবেন, আর লোকটি চাইতে থাকবে। আল্লাহ তাআলা স্মরণ করাতে থাকবেন, আর লোকটি চাইতে থাকবে। অবশেষে আর চাওয়ার মতো কিছু থাকবে না। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘এসব তোমার, তার সাথে আরও দশগুণ (তোমাকে দেওয়া হলো)।’
একটু ভাবো তো—আমরা যে লোকটির কাহিনি শুনছি, সে সর্বশেষে জান্নাতে প্রবেশকারী ব্যক্তি। তার পরে আর কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। সবশেষে জান্নাতে প্রবেশ করলেই যদি তাকে এত নিয়ামাত দেওয়া হয়, তা হলে যারা তারও আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের কী দেওয়া হবে? এ লোকটিই যদি তার চাওয়ার থেকে দশগুণ বেশি পায়, তা হলে তারা কতগুণ বেশি পাবে?
সুবহানাল্লাহ! জান্নাতীদের নিয়ামাত কি গুনে শেষ করা যাবে?
তুমি কি চাও না, এমন জান্নাতে প্রবেশ করতে? তুমি কি চাও না, এই অনাবিল সুখের জায়গাতে তোমার ঠাঁই করে নিতে? তোমার কি ইচ্ছে করে না সেই সৌভাগ্যবানদের একজন হতে, যাদেরকে স্বয়ং আল্লাহ মেহমানদারি করাবেন?
“তাদের (জান্নাতীদের) গায়ে থাকবে সবুজ পাতলা রেশমি কাপড় ও নকশাকরা পুরো রেশমি কাপড়। অলংকার হিসেবে তাদের পরানো হবে রুপোর কঙ্কণ। আর তাদের প্রভু তাদেরকে বিশুদ্ধ পানীয় পান করাবেন।”[2]
যদি এই লোকটির মতো বিচারকার্য শেষে তোমায় জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে দেওয়া হয়, তবুও তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোমার আগেই অগণিত মানুষ পৌঁছে যাবে জান্নাতে। ডুবে থাকবে জান্নাতি নিয়ামাতের সাগরে। তুমি তো পিছিয়ে পড়বে তাদের থেকে। তবে কেন সে চেষ্টা করবে না, যাতে মৃত্যুর পর-পরই তোমার ঠাঁই হয় জান্নাতে?
“তোমরা এগিয়ে যাও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও সেই জান্নাত লাভের তরে, যার প্রশস্ততা আসমান ও জমিনের মতো। আর তা প্রস্তুত করা হয়েছে—যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি ঈমান আনে তাঁদের জন্যে। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি যাকে ইচ্ছে তা দান করেন। আল্লাহ বড়োই অনুগ্রহশীল।”[3]
[1] বুখারি, ৭৬৯; মুসলিম, ৩৫৭-৩৭০।
[2] সূরা ইনসান, ৭৬ : ২১।
[3] সূরা হাদীদ, (৫৭) : ২১।