আমি তোমাকে যে কিংবদন্তির কাহিনী শুনাতে চাচ্ছি, তাঁর মুসআব। বাবার নাম উমাইর। খুনাস বিনতু মালিক ছিলেন তাঁর মা। মক্কার এক অভিজাত পরিবারে যাঁর জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন মক্কার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বাবা-মা’র অনেক আদুরে সন্তান ছিলেন তিনি।


ছোটবেলা থেকেই অঢেল বিত্তের মাঝে বেড়ে উঠেছেন মুসআব। না পাওয়ার বেদনা তাঁকে স্পর্শ করেনি কখনো। আদরের সন্তান হওয়ায় যখন যা চেয়েছেন, পেয়েছেন তার চেয়ে ঢের বেশি। মুসআবের বাবা তাঁর জন্যে এমন পোশাকের অর্ডার দিতেন, যা মক্কায় পাওয়া যেত না। সিরিয়া কিংবা ইয়ামান থেকে রয়্যাল ব্র্যান্ডের পোশাক আসত তাঁর জন্যে। নামিদামি ব্র্যান্ডের আতর ব্যবহার করতেন তিনি। সে আতরের ঘ্রাণ এমন হতো যে, তিনি কোনো পথ দিয়ে গেলে মানুষজন তা আন্দাজ করতে পারত। মানুষ বুঝত, এই আতর মুসআব ছাড়া অন্য কারও নয়।


তাঁর চালচলন, পোশাক-আশাক, কথাবার্তায় ছিল আভিজাত্যের ছাপ। আর এই জন্যেই মক্কার অন্যান্য যুবকদের থেকে তাঁকে সহজেই আলাদা করা যেত। যুবক হওয়া সত্ত্বেও বড় বড় নেতাদের সমাবেশে স্থান হতো তাঁর। কুরাইশদের এই সম্ভ্রান্ত ছেলেটি অংশ নিতেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে। মেধা, প্রজ্ঞা আর অভিজাত ব্যক্তিত্বের কারণে কুরাইশদের প্রিয়পাত্র ছিলেন তিনি। অসাধারণ বাগ্মিতা ছিল তাঁর। ব্যক্তিত্ব ছিল চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো। এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বই তাঁকে সত্যের পথের পথিক হতে উদ্‌বুদ্ধ করে।


একদিন তিনি শুনতে পেলেন—মুহাম্মাদ ﷺ নাকি নতুন দ্বীন প্রচার করা শুরু করেছেন। হররোজ সে দ্বীনের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে মানুষ। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে মুহাম্মাদ ﷺ-এর অনুসারীর সংখ্যা। কুরাইশদের শত অত্যাচারের মুখেও মাথা নত করছে না তাঁরা। যত অত্যাচার করা হচ্ছে, তাঁদের ঈমান আরও মজবুত হচ্ছে তত গুণে। এসব শোনার পর তিনি ভাবতে লাগলেন—কেন মানুষ মুহাম্মাদের দিকে এতটা ঝুঁকে পড়ছে? প্রশাসনের লোকেরা তাঁকে জাদুকর বলছে, পাগল বলছে। আবার কেউ কেউ বলছে তাঁকে জিনে ধরেছে। আসল ব্যাপারটা কী? তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সরাসরি মুহাম্মাদ ﷺ-এর সাথে দেখা করবেন।


খোঁজ নিয়ে জানলেন, নবিজি ও তাঁর সাথিরা মাঝেমধ্যে জড়ো হন আরকামের বাড়িতে। সাফা পাহাড়ের পাদদেশেই আরকামের বাড়ি। সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে একদিন সন্ধেবেলায় আরকামের বাড়িতে হাজির হলেন তিনি। গিয়ে দেখলেন, নবিজি ও তাঁর সাহাবিরা সেখানে বসা। তিনিও বসে গেলেন তাদের পাঠচক্রে। মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন মুহাম্মাদ ﷺ-এর কথাগুলো। ইতিমধ্যে জিবরীল আ. এলেন। কুরআনের আয়াত নাজিল হলো। রাসূল ﷺ সাহাবিদের তা পাঠ করে শোনালেন। মুসআব হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলেন আয়াতগুলো। অন্যরকম এক শিহরন অনুভব করলেন। আয়াতগুলো তাঁকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করতে লাগল। চোখেমুখে ফুটে উঠল পরিবর্তনের ঢেউ। মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর দিকে তাকালেন। পবিত্র হাত রাখলেন মুসআবের বুকের ওপর। গভীর প্রশান্তি অনুভব করলেন মুসআব। ঈমান তাঁর অন্তরে দৃঢ় হলো। এদিনই মুসলিম হলেন তিনি।


মুসআব তাঁর মাকে খুব ভয় করতেন। তাই ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি গোপন রাখলেন। চুপিচুপি যেতে লাগলেন নবিজির পাঠচক্রে। দারুল আরকামে যাওয়া-আসাও চলতে থাকল। একদিন দারুল আরকামে ঢোকার সময় উসমান ইবনু তালহা দেখে ফেলল তাঁকে। আরেকদিন সালাত আদায় করার সময়ও ধরা পড়লেন হাতেনাতে। তাঁর ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি আর গোপন থাকল না। মক্কার অলিতে-গলিতে সে খবর ছড়িয়ে গেল পবনবেগে। পৌঁছে গেল তাঁর মা’র কানেও।


মক্কার মুশরিকরা যারপরনাই বিস্মিত হলো এ খবর শুনে। তারা কোনোভাবেই বিষয়টা মেনে নিতে পারছিল না। মুসআবের মতো প্রিন্স কিভাবে মুহাম্মাদ ﷺ-এর ওপর ঈমান আনতে পারে? তাঁর মতো প্রজ্ঞাবান যুবকের ওপরেও কি মুহাম্মাদ ﷺ জাদু করল?


মুসআবকে হাজির করা হলো মক্কার নেতাদের সামনে। তাঁর মাকেও ডেকে আনা হলো। শুরু হলো উপদেশ-পর্ব। সবাই মিলে তাঁকে বোঝাতে লাগল—এটা তুমি কী করলে? অভিজাত বংশের ছেলে হয়েও গরিবদের সাথে ওঠাবসা শুরু করে দিলে? তোমার বিচার-বিবেচনা বোধ কি সব লোপ পেয়েছে? এত সহজেই মুহাম্মাদ তোমার ব্রেইন ওয়াশ করে দিল?


ওদের কত্থাগুলো মুসআবের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারল না। একটুও বিচলিত হলেন না তিনি। উপদেশ-পর্ব শেষ হলে তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন কুরআন থেকে। শোনাতে লাগলেন রবের অমীয় বাণী। তিলাওয়াত শুনে তাঁর মা রেগে গেলেন। মারধরও করলেন। কিন্তু চুপচাপ সব সয়ে নিলেন মুসআব। এই অবস্থা দেখে মুশরিকরা রাগে-ক্ষোভে জ্বলতে লাগল।


সেদিন বাড়ি ফেরার পর তাঁর মা তাঁকে ঘরে বন্দি করে রাখলেন। একেবারে তিন স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তার মধ্যে বন্দি করা হলো প্রিন্স মুসআবকে। বন্দি অবস্থায় চলতে থাকল নির্যাতন। বারবার তাঁকে ইসলাম ছাড়ার প্রস্তাব দেওয়া হলো। কিন্তু এক চুলও নড়লেন না তিনি। আসলে সৃষ্টির ভয় তাঁকে ভীত করতে পারেনি। ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা রহ. বলেছেন,


‘সৃষ্টিকে কেবল সে-ই ভয় করতে পারে, যার অন্তরে রোগ আছে।’

সাইয়িদ আবুল হাসান আলি, সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস, ২/৫৪।


মুসআবের অন্তর ছিল সকল প্রকার কলুষতা থেকে মুক্ত। এমন অন্তর কিভাবে সৃষ্টির অত্যাচারে ভীত হতে পারে। শত নির্যাতনও টলাতে পার না তাঁকে। একদিন সবার চোখে ধুলো দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন তিনি। হিজরত করলেন হাবশায়। কিন্তু মনটা যেন মক্কাতেই রয়ে গেল। যাঁর জন্যে ঘর ছেড়েছেন, পরিবার ছেড়েছেন, আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়েছেন—তাঁকে মক্কায় রেখে কিভাবে শান্তিতে ঘুমোবেন তিনি!


হাবশা থেকে ফিরে এলেন মক্কায়। মক্কায় আসার পর মা তাঁকে আবার বন্দি করতে চাইল। নির্ভীক মুসআব এবার কসম খেয়ে বললেন, ‘মা! আল্লাহর শপথ! যদি তুমি এমনটা করো আর কেউ যদি এ কাজে তোমাকে সাহায্য করে, তা হলে আমি সবাইকে হত্যা করব।’ ছেলের কথা শুনে মা ভীত হলেন। মা জানতেন—সন্তান ভয়ানক জেদি। ছেলে যেহেতু কসম কেটেছে, তাঁকে আর ফেরানো সম্ভব হবে না। কিন্তু মনকে মানাতে পারছিলেন না। তিনি যে অনেক ভালোবাসতেন মুসআবকে। তাই ঈমান ছেড়ে দিয়ে বাসায় থেকে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করলেন তাঁকে। কিন্তু ছেলেকে কিছুতেই রাজি করানো গেল না। মানুষের ভালোবাসা কখনোই আল্লাহর ভালোবাসার ওপর প্রাধান্য পেতে পারে না। এটাই ঈমানের দাবি।


“… যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, আর ওই ব্যবসা যাতে মন্দা দেখা দেওয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাকো এবং যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ করো—এসব যদি আল্লাহ‌ ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চাইতেও তোমাদের কাছে বেশি প্রিয় হয়, তা হলে আল্লাহর ফয়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। আল্লাহ ফাসিকদেরকে কখনো হিদায়াত করেন না।”

[সূরা তাওবা, ০৯ : ২৪]


তাই তো মায়ের ভালোবাসার ওপর আল্লাহর ভালোবাসাকে প্রাধান্য দিলেন মুসআব। রাজপ্রাসাদ আর প্রিন্সের জীবন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বিদায়বেলায় মা-ছেলের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল জমিনে। এক সময়কার প্রিন্স, এক কাপড়ে বের হয়ে এলেন বাড়ি থেকে। বিলাসী মুসআবের গায়ে রেশমের বদলে এবার উঠল চটের বস্তার মতো মোটা কাপড়।


একদিন আল্লাহর রাসূল ﷺ তাঁর সাহাবিদের সাথে বসা। মুসআবও তাঁদের সাথেই ছিলেন। কিন্তু আজ তাঁর গায়ে চিরচেনা পরিপাটি পোশাক দেখা যাচ্ছে না। ছেঁড়া জামা জড়িয়ে বসে আছেন তিনি। জায়গায় জায়গায় লাগানো হয়েছে চামড়ার তালি।


এ অবস্থা দেখে মুসআবের ইসলামপূর্ব জীবনের ছবি সাহাবিদের চোখে ভেসে উঠল। এ কি সেই মুসআব—যে দামি কাপড় ছাড়া বাইরে বের হয়নি কোনোদিন? সাহাবিদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। রাসূল ﷺ বললেন, ‘মক্কায় মুসআবের চেয়ে সুদর্শন ও উৎকৃষ্ট পোশাকধারী আর কেউ ছিল না। তাঁর চেয়ে পিতা-মাতার বেশি আদরের আর কোনো যুবক ছিল না। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসায় সে সবকিছু ত্যাগ করেছে।’


কিছুদিন পরের ঘটনা। হজের মৌসুম চলছে তখন। মদীনা থেকে আসা কিছু লোক রাসূল ﷺ-এর কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করল। তারপর ফিরে গেল মদীনায়। মদীনার মুসলিমদের দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার জন্যে নবিজি কাউকে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। মুসআবকে মদীনায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। মক্কায় মুসআবের চেয়ে বয়সে বড় অনেক সাহাবি ছিলেন। তবুও তাঁকেই দূত হিসেবে মনোনীত করা হলো। তাঁর বাগ্মিতা, মেধা, আখলাক, কুরবানি—মুগ্ধ করেছিল নবিজিকে।


মুসআব ইসলামের শিক্ষা দিতে লাগলেন মদীনায়। তাঁর দাওয়াতে মুসলিম হলো উসাইদ-সহ আরও অনেক বড় বড় নেতা। মদীনায় বইতে শুরু করল ইসলামি বিপ্লবের বাতাস। দ্রুত গতিতে বয়ে চলল সময়।


ইতিমধ্যেই রাসূল ﷺ মদীনায় হিজরত করেছেন। মক্কার মুশরিকদের অত্যাচার থেকে এতদিনে স্বস্তি পেয়েছে মুসলিমরা। মুসলিমদের সুখ-শান্তি দেখে কুরাইশরা রাগে-ক্ষোভে জ্বলতে লাগল। ইসলামের নিশানা মিটিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো তারা। মুসলিম ও কুরাইশরা মুখোমুখি হলো বদরের প্রান্তরে। মুসলিমদের ধ্বংস করা তো দূরের কথা, একেবারে নাকানিচুবোনি খেয়ে বিদায় হলো কুরাইশ বাহিনী। কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালাল। কিন্তু কিছুদিন যেতে-না-যেতেই আবার যুদ্ধ হলো দু-বাহিনীর মধ্যে। উহুদের প্রান্তরে একত্র হলো উভয় বাহিনী। যুদ্ধ শুরুর আগে কার হাতে ইসলামের পতাকা তুলে দেওয়া যায়, রাসূল ﷺ তাই নিয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি গভীরভাবে উপস্থিত সাহাবিদের নিরীক্ষণ করলেন। এরপর মুসআবকে ডেকে ইসলামের পতাকা তুলে দিলেন।


যুদ্ধ শুরু হলো। একেবারে কোণঠাসা হয়ে গেল কুরাইশরা। কিন্তু শেষের দিকে এসে মুসলিমদের ওপর তুমুল আক্রমণ করার সুযোগ পেল ছোট্ট একটি ভুলের কারণে। বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ল মুসলিম-বাহিনী। এই সুযোগে কুরাইশরা টার্গেট করল নবিজিকে। যুবক মুসআব বিপদের তীব্রতা অনুভব করলেন। উঁচু করে তুলে ধরলেন ঝাণ্ডা। তাকবীর দিতে লাগলেন উচ্চস্বরে। ঘোড়া ছুটিয়ে গেলেন নবিজিকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যে। এক হাতে ঝাণ্ডা, আরেক হাতে তলোয়ার নিয়ে তিনি শত্রুবাহিনীর মধ্যে ঢুকে গেলেন। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে কাঁপিয়ে তুললেন আকাশ-বাতাস। যুদ্ধ করতে লাগলেন বীর-বিক্রমে। একজন মুসআব পরিণত হলেন আস্ত একটি সেনাবাহিনীতে।


তিনি দেখতে পেলেন, শত্রুরা রাসূল ﷺ-এর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। ঘোড়া ছুটিয়ে দ্রুত নবিজির কাছে পৌঁছোলেন তিনি। আক্রমণের তীব্রতা অনুভব করতে পেরে নবিজির জন্যে ঢাল বানালেন নিজের শরীরকে। ইবনু কামীয়ার আঘাতে তাঁর ডান হাত বিচ্ছিন্ন হলো দেহ থেকে। সাথে সাথে বাম হাতে ঝাণ্ডা তুলে নিলেন। পুরোষোচিত স্বরে আবৃত্তি করলে লাগলেন— وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ الرُّسُلُ  (ওয়ামা মুহাম্মাদুন ইল্লা রসূল, কদ খলাত মিং কবলিহির রসূল)। কিছুক্ষণ পর তাঁর বাম হাতটিও দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হলো। কর্তিত বাহু দ্বারাই তিনি ইসলামের ঝাণ্ডা উঁচু করে ধরলেন, আর সেই একই বুলি আওড়াতে থাকলেন। এবার তাঁকে লক্ষ করে বর্শা নিক্ষেপ করা হলো। বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেল বর্শাটি। বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন মুসআব। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রাসূল ﷺ-এর সুরক্ষার জন্যে লড়াই করলেন তিনি।


যুদ্ধ শেষ হলো। শহীদদের লাশ জড়ো করা হলো একজায়গায়। মুসআবের লাশটিও আনা হলো। রক্ত আর ধুলোবালিতে তাঁর চেহারা একাকার। এ দৃশ্য দেখে সাহাবিরা কাঁদতে লাগলেন। কাঁদলেন নবিজিও। খাব্বাব রা. বলে উঠলেন—‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা আল্লাহর রাস্তায় হিজরত করেছিলাম। আমাদের এ কাজের প্রতিদান দেওয়া আল্লাহর দায়িত্ব। আমাদের মধ্যে যাঁরা এ কাজের কোনো প্রতিদান না নিয়েই দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, মুসআব তাঁদেরই একজন।’


মুসআবকে কাফন দেওয়ার জন্যে চাদর আনা হলো। একপ্রস্থ চাদর ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। সে চাদর দিয়ে মাথা ঢাকলে পা, আর পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিল। শেষমেশ রাসূল ﷺ বললেন, ‘মাথার দিকে যতটুকুন ঢাকা যায়, চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। আর পায়ের দিকে ইযখীর ঘাস দিয়ে দাও।’ নবিজির নির্দেশমতো তা-ই করা হলো। মুসআবের কাছে দাঁড়িয়ে রাসূল ﷺ কুরআন কারীমের একটি আয়াত পাঠ করলেন :


“মুমিনদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার সত্যে পরিণত করেছে। তাদের কেউ কেউ (সে অঙ্গীকার পালনের উদ্দেশ্যে) শাহাদাত বরণ করেছে। আবার কেউ কেউ (শাহাদাতের) অপেক্ষায় আছে। তারা (তাদের অঙ্গীকার) তিল পরিমাণও পরিবর্তন করেনি।”

[সূরা আল-আহযাব, ৩৩ : ২৩]


মুসআবের দিকে তাকিয়ে নবিজি বললেন, ‘আমি তোমাকে মক্কায় দেখেছি। সেখানে তোমার চেয়ে কোমল চাদর এবং সুন্দর যুলফি আর কারও ছিল না। কিন্তু আজ তুমি এই চাদরে ধুলোমলিন অবস্থায় পড়ে আছ। আল্লার রাসূল সাক্ষ্য দিচ্ছেন, কিয়ামতের দিন তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে সাক্ষ্যদানকারী হবে।’


এরপর রাসূল ﷺ তাঁর সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আদম-সন্তান, তোমরা তাঁদের জিয়ারত করো। তাঁদের কাছে আসো। তাঁদের ওপর সালাম পেশ করো। সেই সত্তার শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ! কিয়ামত পর্যন্ত যে-ই তাঁদের ওপর সালাম পেশ করবে, তাঁরা সেই সালামের জবাব দেবে।’
মুসআব শহীদ হওয়ার পরপরই জিবরীল আ. এলেন। নাজিল হলো :


وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهِ الرُّسُلُ ۚ أَفَإِن مَّاتَ أَوْ قُتِلَ انقَلَبْتُمْ عَلَىٰ أَعْقَابِكُمْ ۚ وَمَن يَنقَلِبْ عَلَىٰ عَقِبَيْهِ فَلَن يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا ۗ وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ ١٤٤
“মুহাম্মাদ একজন রাসূল ছাড়া কিছুই নয়। তার পূর্বেও অনেক রাসূল গত হয়েছে। কাজেই সে যদি মারা যায় অথবা নিহত হয়, তবে কি তোমরা উল্টোদিকে ফিরে যাবে? যে ব্যক্তি উল্টোদিকে ফিরে দাঁড়ায়, সে আল্লাহর কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। এবং আল্লাহ অতি শীঘ্রই কৃতজ্ঞদের বিনিময় প্রদান করবেন।”

[আলি ইমরান, ০৩ : ১৪৪]

সুবহান্নাল্লাহ! এক মিনিট একটু চোখটা বুজো তো। এরপর ভাবো। যে বাক্যটা মুসআব মৃত্যুর আগে পড়ছিলেন, সে আয়াতটিই নিয়ে এলেন জিবরীল। মুসআবের উচ্চারিত বাক্য আর মহান রবের পাঠানো আয়াত—হুবহু মিলে গেল।


মুসআব তাঁর রবের সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করেছেন যে, তাঁর রব তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট। না, এ দাবি আমার নয়। কুরআন খুলো, নিজেই বুঝতে পারবে। কুরআনের একাধিক আয়াতে এ কথা বলা হয়েছে। সাথে সাথে এও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেউ যদি মুসআবদের অনুসরণ করতে পারে, তবে আল্লাহ তাঁর প্রতিও সন্তুষ্ট হবেন।

“আর আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে যারা অগ্রগামী এবং যাবতীয় কাজে যারা তাদেরকে অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্যে প্রস্তুত করে রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্না প্রবাহিত। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই মহাসাফল্য।”

[সূরা তাওবা, ০৯ : ১০০]


আমি মুসআবকে জীবন্ত কিংবদন্তি কেন বলেছি, জানো?
‘যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে কখনো মৃত বোলো না, বরং তারা জীবিত। তারা তাদের রবের কাছ থেকে জীবিকাপ্রাপ্ত।’
ভাই আমার! আজ তুমি কাদের কিংবদন্তি বলছ?
অনুসরণ করছ কাদের?
কাদেরকে জীবনের মডেল বানিয়েছ?


আল্লাহ যাঁদেরকে তোমার জন্যে মডেল বানালেন, তাঁদেরকে দূরে ঠেলে আজ তুমি কাদের পাল্লায় পড়েছ? কাদের ড্রেসআপ, কাদের স্টাইল, কাদের চালচলন বেছে নিয়েছ নিজের জন্যে? তুমি কি তোমার অবস্থান নিয়ে ভেবেছ কোনোদিন? তুমি যে অবস্থায় আছ সে অবস্থায় যদি মারা যাও, তা হলে তোমার স্থান কোথায় হবে?


বিশ্বাস করো, তুমি যদি জাহিলি অবস্থাতেই মারা যাও তবে হয়তো দুনিয়ার কিছু মানুষ তোমায় মনে রাখবে। কিন্তু আসমানের অধিবাসীদের কেউই তোমাকে স্মরণ করবে না। তাঁদের কেউ কাঁদবে না তোমার জন্যে। কেউ সালাত ও তাসলিম পেশ করবে না তোমার প্রতি। আর যদি মুসআব হতে পারো, তা হলে তোমার নাম তাঁদের সাথে লেখা হবে যাঁদের নাম শুনলেই আমরা পড়ি—রদিয়াল্লাহু আনহুম (আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট)।


আমাকে বলো তো, কেন তুমি অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে আসছ না? তোমার সম্পদ কি মুসআবের থেকেও বেশি? তুমি কি তাঁর চেয়েও বেশি আদরে লালিত-পালিত হয়েছ? নাকি তোমার বাবা তাঁর বাবার চেয়েও বড় ব্যবসায়ী? আভিজাত্যের মধ্যে বেড়ে ওঠার পরও মুসআব যদি দ্বীনের পথে আসতে পারে, তবে তোমার কী অজুহাত থাকতে পারে?


সত্যিই, তোমার অন্তর মরে গেছে। দুনিয়ার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে গেছ তুমি। ক্যারিয়ারের মোহ তোমাকে বধির করে ফেলেছে। সম্পদের তুমি নেশায় মাতাল হয়ে আছ। ভাই আমার! যদি জানতে তোমার জীবন থেকে কী হারিয়ে গেছে, তা হলে খুব কমই হাসতে। কাঁদতে অনেক বেশি। অঝোর ধারায় কাঁদতে।