একটা হাদিস বলি। আশা করি এতে টনক নড়বে। হাদিসটি বর্ণনা করেছেন সাওবান । নবি ﷺ একদিন বললেন, ‘আমি আমার উম্মতের কতক দল সম্পর্কে অবশ্যই জানি, যারা কিয়ামতের দিন তিহামার শুভ্র পর্বতমালার সমতুল্য নেক আমল নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু মহামহিম আল্লাহ সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করে দেবেন।’
সাওবান তখন জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাদের পরিচয় স্পষ্টভাবে আমাদের জানিয়ে দিন। যাতে অজ্ঞাতসারেও আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত না হই।’ জবাবে নবি ﷺ বললেন, ‘তারা তোমাদেরই জ্ঞাতিভাই এবং তোমাদের সম্প্রদায়েরই লোক। তারা রাতের বেলা তোমাদের মতোই ইবাদত করবে। কিন্তু একান্ত গোপন অবস্থায় আল্লাহর হারামকৃত বিষয়ে লিপ্ত হবে।’[1]


বান্দার সমস্ত আমল ধ্বংস হয়ে যাবে গোপন পাপের কারণে। অথচ আজকে গোপন পাপাচারের পেছনে ‘কনসেন্ট’, ‘ভ্যালেন্টাইন’, ‘পহেলা ফাল্গুন’ ইত্যাদি নানান ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হচ্ছে! নিঃসন্দেহে এগুলো গর্হিত অপরাধ। চিরদিনের জন্যে যিনা একটি মারাত্মক অপরাধ। এটা মানুষের ঈমান নড়বড়ে করে দেয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,


“যখন কোনো বান্দা যিনায় লিপ্ত হয়, তখন তার থেকে ঈমান বেরিয়ে যায় এবং তা তার মাথার ওপর ছায়ার ন্যায় অবস্থান করতে থাকে। যখন সে এ (নোংরা কাজ থেকে) বিরত হয়, তখন ঈমান তার নিকট ফিরে আসে।”[2]


যিনায় লিপ্ত থাকা অবস্থায় একজন মানুষের ঈমান মাথার ওপর ঝুলতে থাকে। অথচ আমাদের সমাজ এই অপরাধকে মনে করে পবিত্র জিনিস! এই নিকৃষ্ট অপরাধ করার পর বুক ফুলিয়ে বলে—‘আমি ওকে ভালোবাসি!’ ‘আমি তার জন্যে জীবন দিতে প্রস্তুত!’ ‘ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না!’


‘ভালোবাসা’ দিবস নাম দিয়ে যিনাকে এখন সেলিব্রেট করা হচ্ছে। হারাম রিলেশনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে ট্রিট পাচ্ছে বন্ধুরা! শুধু তাই নয়, লাভাররা সোশ্যাল প্লাটফর্মে এসে স্টেটাস দিচ্ছে—In a relationship (নাউজুবিল্লাহ)। একদিকে এত বড় গোনাহ, অপরদিকে সেই গোনাহকে সেলিব্রেট! তাও আবার পাব্লিক-প্লেসে!! কত জঘন্য অবস্থার মধ্যে চলে গিয়েছে আমাদের সমাজ!!! যেখানে আল্লাহ যিনার ধারেকাছে যেতেও বারণ করেছেন, সেখানে যিনা চলাকালীন তারা ভিডিও শুট করছে। অনেকেই নিজেদের অন্তরঙ্গ দৃশ্য বন্ধুদের দেখিয়ে বেড়াচ্ছে, অনেকেই আবার গ্রুপ সেক্স করছে প্রেমিকাকে নিয়ে[3]!!!


এই-যে খোলামেলা অশ্লীলতা, এর শাস্তি কিন্তু খুব ভয়ানক। আবু হুরাইরা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছি—

“আমার সকল উম্মত ক্ষমা পাবে, (তবে নিজের পাপের কথা) প্রকাশকারী ব্যতীত। নিশ্চয় এটা অনেক বড় ধৃষ্টতা যে, কোনো ব্যক্তি রাতে অপরাধ করল—যা আল্লাহ গোপন করে রাখলেন। কিন্তু ভোর হলে সে বলে বেড়াতে লাগল: এই, শুনো! আমি আজ রাতে এমন কাজ করে ফেলেছি।… আল্লাহ তার কর্মের (ওপর পর্দা দিয়ে তা) গোপন রেখেছিলেন, আর ভোরে ওঠে সে তার ওপর থেকে আল্লাহর দেওয়া পর্দা খুলে ফেলল!”[4]


মিরাজের রাত্রিতে নবিজিকে জাহান্নামের বিভিন্ন শাস্তি দেখানো হয়। তিনি দেখতে পান একটি আগুনের গর্ত। সেখানে বহুসংখ্যক নারী-পুরুষ উলঙ্গ অবস্থায় শাস্তি পাচ্ছে। নবি কারীম ﷺ ওদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। তাঁকে জানানো হয়, এরা হলো যিনাকারী।[5] অপর-এক হাদিসে নবি কারীম ﷺ বলেন, ‘আমার কাছে দুজন লোক আসলো। তারা আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ দেখলাম, আমি কিছু লোকের পাশ দিয়ে যাচ্ছি যারা খুবই ফুলেফেঁপে আছে। তাদের গন্ধ এত প্রকট যে, মনে হচ্ছে তারা গণশৌচাগার। আমি বললাম, এরা কারা? জানানো হলো, এরা ব্যভিচারী পুরুষ ও নারী।’[6]


হাল জামানার ছেলে-মেয়েরা ওপেনলি তাদের হারাম রিলেশনের কথা জানান দেয়। আর শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোটা এখন তো খুব স্বাভাবিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা যেন প্রেমের অধিকার! ছেলেপেলেরা রিলেশন করে এটার লোভেই। কেউ সেঞ্চুরি, কেউ হাফ সেঞ্চুরি, কেউ টি-টোয়েন্টি… কত রকম ম্যাচ যে এরা খেলে! অনেক পিতামাতাও এইক্ষেত্রে সাপোর্ট দিয়ে যায়। তারা জানে যে, সন্তান হারাম রিলেশনে জড়িত। কিন্তু বাধা দেয় না। হারাম জুটিকে একসাথে ঘুরাফেরা করতে দেখেও তারা ঘাবড়ে যায় না। অনেক এডভান্স পিতামাতা তো বেডরুমে বন্ধুর সাথে মেয়েকে খোশগল্প করতে দেখেও ভুরু কুঁচকায় না। বরং সাধুবাদ জানায়। বাসায় এনে মেয়ের প্রেমিককে দাওয়াত খাওয়ায়, এমন মডার্ন পিতার উদাহরণ কি নেই?
এটা তো গেল সাধারণ মানুষের অবস্থা! অনেক লেবাসধারীরাও এসব থেকে মুক্ত না। দাড়ি-টুপি-ওয়ালা কিছু লোকও এই যিনা-ব্যভিচারে জড়িত। আসলে তাদের কথার সাথে কাজের মিল নেই। আপনি চাইলেই গাইরে মাহরামের সাথে একান্তে গল্প করতে পারবেন না। হোক তা ভয়েস কলে অথবা চ্যাটিং-এর মাধ্যমে। ফেসবুকে অনেক মেয়ে আছে, যারা গায়ে পড়ে ছেলেদের পোস্টে কমেন্ট করে। একজন ভালো লিখলে বা গঠনমূলক আলোচনা করলে তার ইনবক্সে সরাসরি মেসেজ দেয়। রিপ্লে পেলে লাভ রিয়েক্ট দেয়। মেসেঞ্জারের এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে। কী দরকার এসবের? ওই ছেলেটা কি আপনার গাইরে মাহরাম নয়? তাহলে ওর ইনবক্সে কী করছেন?


একই কথাটা ভাইদের জন্যেও। কোনো গাইরে মাহরাম মেয়েকে টেক্সট করার আগে শতবার ভাবা দরকার নয় কি? আপনি তাকে চেনেন না, জানেন না—প্রপোজ করে দিচ্ছেন মাসনার জন্যে? আপনার আত্মসম্মানবোধ কবে থেকে এতটা তলানিতে গিয়ে ঠেকল?


মুখে মুখে দ্বীনের কথা বললেও অনেকেই ধরা খায় এ যায়গায় এসে। দ্বীনদারিতার বেশভূষা গ্রহণ করলেও, অগোচরে এসব গোনাহয় জড়িয়ে পড়ে। এরা মানুষকে ঠিকই যিনা থেকে দূরে থাকার নসিহা দেয়, অথচ নিজেরাই আবার লুতুপুতু করে মেয়েদের সাথে। ওপরে ওপরে যিনা-ব্যভিচার নিয়ে পোস্ট লিখে, কিন্তু তলে-তলে চলে গুঁতাগুঁতি। এদের শাস্তি আরও ভয়ানক। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “কিয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আনা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আগুনে পুড়ে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। এ সময় সে ঘুরতে থাকবে, যেমন গাধা তার চাকা নিয়ে তার চারপাশে ঘুরতে থাকে। জাহান্নামীরা তার নিকট জড়ো হয়ে বলবে, ‘হে অমুক! তোমার এই অবস্থা কেন? তুমি-না আমাদেরকে সৎকাজের আদেশ দিতে আর অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করতে?’ সে বলবে, ‘আমি তোমাদেরকে সৎকাজের আদেশ দিতাম বটে, কিন্তু নিজে তা পালন করতাম না। আর তোমাদেরকে অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকতে বলতাম ঠিকই, অথচ নিজেই তাতে লিপ্ত হয়ে যেতাম (সে জন্যেই আমার এই দশা)।’”[7]


একটা ছেলে পাতি-সেলিব্রেটি হয়েছে, এখন সে মেয়েদের গ্রুপে পণ্ডিতি ফলাচ্ছে। ইনবক্সে মেয়েদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। জটিল জটিল মাসালা নিয়ে আলোচনা করছে। বিশ্বাস করুন, যতবড় বুজুর্গই সে হোক না কেন, একান্তে পরনারীর সাথে কথা বললে খারাপ ভাবনা মনে আসবেই। রাসূল ﷺ বলেছেন, “সাবধান! কোনো পুরুষ কোনো মহিলার সাথে নির্জনে মিলিত হলে, সেখানে তৃতীয়জন হিসেবে শয়তান আগমন করে।”[8] আর শয়তান যখন চলে আসে, তখন বাদবাকি কাজ সে-ই চালিয়ে নেয়।


আমরা প্রায়ই দেখি, অমুক ভাইয়ের স্ক্রিনশর্ট ফাঁস হচ্ছে, তমুক ভাইয়ের ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে! একজন লেবাসধারীই তো ধরা খেয়ে বলেছিল—‘এসব এডিট করার যায় ভাই!’ হয়তো তাদের কথা শুরু হয়েছিল কোনো ভালো টপিক দিয়ে। ‘ভাইয়্যা’ আর ‘আপু’ ছাড়া কেউ কাউকে ডাকতোই না। কিন্তু শেষটায় এসে তারা বলছে—‘বাবু খাইছো’, ‘বাবু নামাজ পড়ছো’, ‘কথা দাও বাবু, তুমি পর্দা করবা’…


আল্লাহ তাআলা এমনি-এমনি যিনার কাছে ঘেঁষতে বারণ করেননি। তিনি জানেন, কাছে গেলে আমরা সহ্য করতে পারব না। আগুনের কাছে গিয়ে মোম যেমন স্থির থাকতে পারে না, তেমনি যিনার কাছাকাছি হলে আমরাও নিজেকে সংবরণ করতে পারবে না। কারণ, নারীদেকে বানানোই হয়েছে আকর্ষণীয় রূপ দিয়ে। আমাদের ফিতরাত তাদের দিকে এমনিতেই আকর্ষিত হয়। এটা আমরা অস্বীকার করব কোন যুক্তিতে?


“মানুষের জন্য নারী, সন্তান, সোনা-রূপার স্তূপ, সেরা ঘোড়া, গবাদি পশু ও কৃষিক্ষেতের প্রতি আসক্তিকে বড়ই সুসজ্জিত ও সুশোভিত করা হয়েছে।”[9]


ফিতরাতের এই চাওয়া-পাওয়াকে আমরা অস্বীকার করতে পারব না। নারী-পুরুষ একান্তে মিলিত হলে, এই খায়েশাতের কাছে নির্ঘাত তারা পরাজিত হবে। তাই অন্তরাল বা পর্দা ছাড়া গাইরে মাহরামের সাথে যোগাযোগ রাখা খুবই বিপজ্জনক। একদিন-না-একদিন যিনার দিকে শয়তান টেনে নিয়ে যাবেই। সেটা হোক কথার যিনা, চোখের যিনা বা লজ্জাস্থানের যিনা। যেহেতু শুরুই হয়েছে হারাম যোগাযোগের মাধ্যমেে, তাই শয়তান একটা স্পেস অলরেডি পেয়ে গেছে। এখন সে খুব সহজেই বান্দাকে কাবু করে ফেলতে পারবে।


এই জন্যেই রাসূল ﷺ বলেছেন, “নিশ্চয় আমি তোমাদের ওপর যে ব্যাপারে বেশি ভয় করি তা হচ্ছে যিনা ও গোপন প্রবৃত্তি।”[10] কিন্তু আমরা এই ব্যাপারে অনেক বেখেয়াল। রাসূলুল্লাহ ﷺ মেয়েদের দিকে তাকাতেও নিষেধ করেছেন। অথচ, যুবকরা সেই নজর দিয়েই ঠিক করছে—এই বছর কে কাকে খাবে। এটা কি কোনো মুমিনের চরিত্র হতে পারে? কিভাবে সে ঈমান-বিধ্বংসী যিনাকে নিজের টার্গেট হিসেবে সেটাপ করছে?

কিভাবে সে আল্লাহদ্রোহীদের মতন গোনাহকে প্রকাশ্যে সেলিব্রেট করছে?


[1] ইবনু মাজাহ, ৪২৪৫; সিলসিলা সহীহাহ, ৫০৫।

[2] আবু দাউদ, ৪৬৯০; তিরমিযি, ২৬২৫; সহীহুত তারগীব, ২৩৯৪।

[3] ইয়াবা সেবনের পাশাপাশি বন্ধুদের গ্রুপ সেক্সের শিকার, প্রবাসীর দিগন্ত, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯

[4] বুখারি, ৫৬৪৩।

[5] বুখারি, ১৩৮৬।

[6] তারগীব ওয়াত তাহরীব, ৩৪২৪।

[7] বুখারি, ৩২৬৭; মুসলিম, ২৯৮৯।

[8] তিরমিযি, ২১৬৫।

[9] সূরা আলে ইমরান, ৩ : ১৪।

[10] তারগীব ওয়াত তাহরীব, ৩৪১৯।