যুদ্ধের দামামা বেধে গেল। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পূর্বে হাজ্জাজ একটি কূটকৌশল করল। ফলে অনেক লোক আব্দুল্লাহ ইবনুয যুবাইর রা.-এর পক্ষ ছেড়ে দিয়ে হাজ্জাজের দলে ভিড়ল। খুব কম-সংখ্যক লোকই বাকি রইল। আব্দুল্লাহ ইবনুয যুবাইর রা. তখন তাঁর মায়ের সাথে দেখা করতে গেলেন।

তাঁর মায়ের নাম আসমা বিনতু আবী বকর রা.। তাঁর শরীরে বইছিল সিদ্দিকে আকবারের রক্তধারা। সিদ্দিকের চেতনায় বলীয়ান হয়ে তিনি তাঁর সন্তানকে বলে দিলেন, “ছেলে আমার, শুনো! তুমি যদি নিজেকে সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত মনে করো, তাহলে দৃঢ় থাকো। সত্যের জন্যেই তো তোমার সঙ্গীরা জীবন দিয়েছে। বানূ উমাইয়্যার ছোকরারা যেন তোমার মস্তক নিয়ে খেলার সুযোগ না পায়। আর যদি দুনিয়া তোমার লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে তো তুমি অপদার্থ সন্তান। মনে রেখো—আল্লাহর দ্বীন দুর্বল নয়। কত কালই আর দুনিয়ায় বেঁচে থাকবে? কাজেই শহীদ হওয়াটাই উত্তম। মৃত্যুর ভয়ে শত্রুপক্ষের এমন কোনো শর্ত মেনে নিয়ো না, যা তোমার লাঞ্ছনার কারণ হয়। আল্লাহর কসম! লাঞ্ছনার সঙ্গে বেত্রাঘাতের কষ্ট স্বীকার করার চেয়ে, সম্মানের সাথে শানিত তরবারির আঘাতে মৃত্যুবরণ করা অধিক শ্রেয়। বেরিয়ে পড়ো হে পুত্রধন!” (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৫৭৮)

আব্দুল্লাহ ইবনুয যুবাইর রা. মাকে আলিঙ্গন করলেন শেষবারের মতন। তাঁর মা অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তাই বুঝতে পারেননি যে, ছেলের দেহে বর্ম রয়েছে। আলিঙ্গনের মুহূর্তে তিনি এটা বুঝতে পারলেন। তখন তিনি বলে উঠলেন, “তুমি-না শহীদ হতে যাচ্ছ? এটা তো শাহাদাত-প্রত্যাশী লোকের পোশাক নয়। বর্ম খুলে ফেলো। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো বীরের মতন।”

মায়ের মুখে এই কথা শুনে উদ্দীপ্ত হন ইবনুয যুবাইর রা.। বর্ম খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধের ময়দানে। বীরের মতো লড়াই করতে করতে একসময় শহীদ হয়ে যান। হাজ্জাজের লোকেরা তাঁর মাথা দেহ থেকে আলাদা করে ফেলে। এরপর সেটাকে পাঠিয়ে দেয় আব্দুল মালিকের নিকট। আর তাঁর নিথর দেহ শূলিতে চড়িয়ে রাখে।

আসমা রা. ছেলের লাশের একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু সন্তানের বিয়োগব্যথায় আহাজারি করে বুক ভাসাননি তিনি। তাঁর মনে ছিল পাহাড়সম দৃঢ়তা। তিনি তো তাঁর সন্তানকে দ্বীনের জন্যেই কুরবানি দিয়েছেন। আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছে তাঁর পুত্রধন। এই গর্বে বুকটা ভরে যাচ্ছিল আসমার। এমন সময় দলবল-সহ হাজ্জাজ তাঁর কাছে আসে। এসে বলে, “কেমন দেখলেন? আল্লাহই তাকে এই শাস্তি দিয়েছেন।”

গোটা আরব তখন হাজ্জাজের ভয়ে ভীত। কেউ টুঁ শব্দটিও করার সাহস করছিল না। কিন্তু সিদ্দিকে আকবারের কন্যা তখন হাজ্জাজকে লক্ষ করে বলেছিলেন, “হাজ্জাজ! তুমি মিথ্যা বলছ। যুবাইর মদীনায় জন্মগ্রহণকারী সর্বপ্রথম মুসলিম সন্তান। তার জন্মে আল্লাহর রাসূল স. আনন্দিত হয়েছিলেন। মুসলিমরা সেদিন তাকবীর ধ্বনি দিয়েছিল। এমনকি পুরো মদীনা আনন্দ প্রকাশ করতে করতে কম্পিত হয়েছিল। অথচ তুমি তাকে হত্যা করে আনন্দ বোধ করছ? তার জন্মে যারা আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন, তারা তোমার দলবলের চেয়ে উত্তম।” (বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/৫৯৫)

আসমা রা.-এর দৃঢ়তা দেখে হাজ্জাজ সেদিন মুখটা কালো করে বিদায় নিয়েছিল। আসলে উম্মাহর মায়েরা এমনই ছিল। তারা তাদের সন্তানকে প্রস্তুত করে দিতেন দ্বীনের জন্যে। শাহাদাতের পথে ছেলেকে পাঠাতে কখনো দ্বিধা করতেন না তাঁরা। তাঁদের মমতার আঁচলেই বেড়ে উঠতেন ইসলামের বীরপুরুষগণ। তাঁদের অনুপ্রেরণা পেয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন মুজাহিদগণ। কিন্তু আজ সেই মায়েরা হারিয়ে গিয়েছে। আজ একজন আসমা নেই, তাই নেই ইবনুয যুবাইর নামের কোনো বীর।